“নিয়ত কাজের কিছু ভুল হয়ে যায়
অকাজের বাজে কিছু ধরে রাখি
ঘুমোনোর প্রয়াসেই জেগে থাকি
এমনি নিবিড় যেন ভালোবাসি, হায়
জানি না সে কারে, কবে, কখন, কোথায়।” (সুখের অসুখ)
কোথায় যেন পড়েছিলাম, ভালোবাসা এক অসুখেরই নাম। কিন্তু প্রেমিকমাত্রই জানেন এ অসুখের সুখ সীমাহীন। মহিউদ্দিন তাহেরের ‘সুখের অসুখ’ কবিতাটা পড়তে গিয়ে এমনটাই মনে হলো। আরো মনে হলো, এই মানুষটি, মানে এই কবি মানুষটি মূলত প্রেমিক, ভীষণ প্রেমিক। ‘আরাধ্য সুন্দর’কে খুঁজে ফেরেন তিনি। ‘শিশিরের স্বপ্ন’ দেখেন তিনি। প্রেমিক এই কবির প্রেম ও বিষাদের স্বরলিপি আরও বেশি করে বেজে ওঠে ‘পত্রালাপ’ সিরিজে।
“তুমি জানো না, যেন তুমি আমার হৃদয়ের শেষতম গভীরে শেকড় বিস্তৃত করেছ এমনভাবে, যেখান থেকে তোমাকে উপড়ে ফেলার উপায় শেষ। কারণ, উপড়ে ফেলতে গেলে হৃদয় শুদ্ধ উপড়ে আসবে শতধা বিক্ষত হয়ে। তুমি আমার আমরণ ভালোবাসার একক মালিকানা পেয়ে গেছ।” (পত্রালাপ-৫)
এটা বেদনাদায়ক, এটা আপত্তিকর যে মহিউদ্দিন তাহেরের কাছ থেকে আমরা একক বই করার মতো প্রেমের কবিতা পেলাম না। এমন বিশ্বাস হয়, তিনি প্রেমে মগ্ন থাকলে, একটি বৃহৎ পরিসরে একজন প্রেমিকের হৃদয়লিপির আরো খোঁজ পাওয়া যেতো।
কখনো কখনো বহুমাত্রিকতা সাধারণ পাঠককে অনেক পথ ঘুরিয়ে মারে। মহিউদ্দিন তাহের কি কোনোভাবে পাঠককে অনেকটা ভ্রমণে পাঠাতে চান।
তাঁর কবিতার বিচিত্র ক্যানভাস দেখে আপাতত তাই মনে হয়। প্রেমের পাশেই তিনি দ্রোহ, সমাজ, রাষ্ট্রভাবনাকে সাজিয়ে দেন। তাঁর একটি কবিতায় পাই
“স্বাধীনতা মানে স্বৈর এবং রাজাকারে মাখামাখি
লীগ-দলে ভাগাভাগি দেশে শুভঙ্করের ফাঁকি” (স্বাধীনতা আজকাল)
এই উচ্চারণে দেশপ্রেমের অন্যপিঠে উঠে আসে দ্রোহ আর ক্রোধ। এই কবির কাছ থেকেই আমরা ‘মেঘলামতি বাংলাদেশ’ কিংবা ‘ও বাঙালি বাংলা বলো’র মতোও কবিতা পেয়ে যাই।
ব্যক্তিজীবন, রাষ্ট্রভাবনা, দেশপ্রেম, অন্য কোনো অনুভব, যা কিছুই লেখেন, মহিউদ্দিন তাহের বৈচিত্র্যের পাশাপাশি পরিমিতি বোধও ধারণ করেন। তাঁর অণুকাব্যগুলো যেন বিন্দুর মাঝেই সিন্ধুর সাজ।
“তুমিই আমার জীবন হয়েছ
হতে পারো ফের মরণও
অসীম সুখের শুকপাখি তুমি
শত বেদনার কারণও।” (তুমিই)
মাত্র চার লাইনের এই অণুকাব্যে জীবন-মরণ, সুখ-বেদনার একক সমীকরণ উঠে আসে সুচারুভাবেই। আকারে অণু হলেও এ কবিতা বৃহত্তর ব্যাখ্যার দাবী রাখে।
সব দাবি-দাওয়ার শেষে একটা জিনিস লক্ষ করতেই হয়, তাহেরের কবিতায় প্রেমের পাশাপাশি গীতলতাও খুব। এটা দুঃখের কথা যে, গীতিকার তাহেরকেও আমরা কম পেয়েছি। গান নিয়েই তার একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হতে পারতো, হওয়া উচিত। একটি গানের অন্তরাদ্বয় প্রারম্ভিকেই তুলে দিই তবে
“আকাশের মতো প্রেম জানি তার সীমা নেই
গতি তার উল্কারও কম নয়
তার চেয়ে চাঁদ মনোরম নয়
এ গতির থামা নেই, দাঁড়ি নেই কমা নেই।
প্রাণে-প্রাণে জাগে প্রেম জানি তার নতি নেই
সুখ হাসে বেদনার পলিতেই
পদে-পদে বাধা পথ চলিতেই
তবু তার গতি আছে, একটুও যতি নেই।” (যতিহীন)
‘জলের লেখা’ কাব্যগ্রন্থের কিছু লেখা আছে আনন্দ কিংবা বেদনার অশ্র“জলে আঁকা। নিবেদন বা নৈবেদ্য সিরিজের এই কবিতাগুলো মহিউদ্দিন তাহের তার পিতা-মাতা-শিক্ষাগুরু প্রমুখকে উৎসর্গ করে লিখেছেন। এরমধ্যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে লেখা কবিতাটি উল্লেখযোগ্য বিবেচনা করি
“জ্বালো আলো বৈভব স্বপ্ন সমান
আলোর শিশুরা ওই
গেয়ে ওঠো থৈ থৈ উদাত্ত প্রাণ:
চাই আলোর জন্যে মানুষ
চাই ভালোর জন্যে মানুষ
চাই পূর্ণপ্রাজ্ঞ মানুষ
কথা নয় কাজের মানুষ
দেশপ্রেমে পূর্ণ মানুষ।” (অনির্বাণ)
দেশপ্রেম, প্রেম, বিরহ, অণু কাব্য ছাড়াও চারটে সনেটও লিখেছেন মহিউদ্দিন তাহের। নানা ছন্দ, মাত্রা ও ভাবনায় পারদর্শীতা দেখিয়েছেন তিনি। পাঠক হিসাবে, দাবি তবু রয়েই গেলো, তার কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন করে প্রেম, দ্রোহ, সনেট ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা আলাদা বই চাই।
কোথায় যেন পড়েছিলাম, ভালোবাসা এক অসুখেরই নাম। কিন্তু প্রেমিকমাত্রই জানেন এ অসুখের সুখ সীমাহীন। মহিউদ্দিন তাহেরের ‘সুখের অসুখ’ কবিতাটা পড়তে গিয়ে এমনটাই মনে হলো।
By মহিউদ্দিন তাহের
Category: কবিতা
“নিয়ত কাজের কিছু ভুল হয়ে যায়
অকাজের বাজে কিছু ধরে রাখি
ঘুমোনোর প্রয়াসেই জেগে থাকি
এমনি নিবিড় যেন ভালোবাসি, হায়
জানি না সে কারে, কবে, কখন, কোথায়।” (সুখের অসুখ)
কোথায় যেন পড়েছিলাম, ভালোবাসা এক অসুখেরই নাম। কিন্তু প্রেমিকমাত্রই জানেন এ অসুখের সুখ সীমাহীন। মহিউদ্দিন তাহেরের ‘সুখের অসুখ’ কবিতাটা পড়তে গিয়ে এমনটাই মনে হলো। আরো মনে হলো, এই মানুষটি, মানে এই কবি মানুষটি মূলত প্রেমিক, ভীষণ প্রেমিক। ‘আরাধ্য সুন্দর’কে খুঁজে ফেরেন তিনি। ‘শিশিরের স্বপ্ন’ দেখেন তিনি। প্রেমিক এই কবির প্রেম ও বিষাদের স্বরলিপি আরও বেশি করে বেজে ওঠে ‘পত্রালাপ’ সিরিজে।
“তুমি জানো না, যেন তুমি আমার হৃদয়ের শেষতম গভীরে শেকড় বিস্তৃত করেছ এমনভাবে, যেখান থেকে তোমাকে উপড়ে ফেলার উপায় শেষ। কারণ, উপড়ে ফেলতে গেলে হৃদয় শুদ্ধ উপড়ে আসবে শতধা বিক্ষত হয়ে। তুমি আমার আমরণ ভালোবাসার একক মালিকানা পেয়ে গেছ।” (পত্রালাপ-৫)
এটা বেদনাদায়ক, এটা আপত্তিকর যে মহিউদ্দিন তাহেরের কাছ থেকে আমরা একক বই করার মতো প্রেমের কবিতা পেলাম না। এমন বিশ্বাস হয়, তিনি প্রেমে মগ্ন থাকলে, একটি বৃহৎ পরিসরে একজন প্রেমিকের হৃদয়লিপির আরো খোঁজ পাওয়া যেতো।
কখনো কখনো বহুমাত্রিকতা সাধারণ পাঠককে অনেক পথ ঘুরিয়ে মারে। মহিউদ্দিন তাহের কি কোনোভাবে পাঠককে অনেকটা ভ্রমণে পাঠাতে চান।
তাঁর কবিতার বিচিত্র ক্যানভাস দেখে আপাতত তাই মনে হয়। প্রেমের পাশেই তিনি দ্রোহ, সমাজ, রাষ্ট্রভাবনাকে সাজিয়ে দেন। তাঁর একটি কবিতায় পাই
“স্বাধীনতা মানে স্বৈর এবং রাজাকারে মাখামাখি
লীগ-দলে ভাগাভাগি দেশে শুভঙ্করের ফাঁকি” (স্বাধীনতা আজকাল)
এই উচ্চারণে দেশপ্রেমের অন্যপিঠে উঠে আসে দ্রোহ আর ক্রোধ। এই কবির কাছ থেকেই আমরা ‘মেঘলামতি বাংলাদেশ’ কিংবা ‘ও বাঙালি বাংলা বলো’র মতোও কবিতা পেয়ে যাই।
ব্যক্তিজীবন, রাষ্ট্রভাবনা, দেশপ্রেম, অন্য কোনো অনুভব, যা কিছুই লেখেন, মহিউদ্দিন তাহের বৈচিত্র্যের পাশাপাশি পরিমিতি বোধও ধারণ করেন। তাঁর অণুকাব্যগুলো যেন বিন্দুর মাঝেই সিন্ধুর সাজ।
“তুমিই আমার জীবন হয়েছ
হতে পারো ফের মরণও
অসীম সুখের শুকপাখি তুমি
শত বেদনার কারণও।” (তুমিই)
মাত্র চার লাইনের এই অণুকাব্যে জীবন-মরণ, সুখ-বেদনার একক সমীকরণ উঠে আসে সুচারুভাবেই। আকারে অণু হলেও এ কবিতা বৃহত্তর ব্যাখ্যার দাবী রাখে।
সব দাবি-দাওয়ার শেষে একটা জিনিস লক্ষ করতেই হয়, তাহেরের কবিতায় প্রেমের পাশাপাশি গীতলতাও খুব। এটা দুঃখের কথা যে, গীতিকার তাহেরকেও আমরা কম পেয়েছি। গান নিয়েই তার একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হতে পারতো, হওয়া উচিত। একটি গানের অন্তরাদ্বয় প্রারম্ভিকেই তুলে দিই তবে
“আকাশের মতো প্রেম জানি তার সীমা নেই
গতি তার উল্কারও কম নয়
তার চেয়ে চাঁদ মনোরম নয়
এ গতির থামা নেই, দাঁড়ি নেই কমা নেই।
প্রাণে-প্রাণে জাগে প্রেম জানি তার নতি নেই
সুখ হাসে বেদনার পলিতেই
পদে-পদে বাধা পথ চলিতেই
তবু তার গতি আছে, একটুও যতি নেই।” (যতিহীন)
‘জলের লেখা’ কাব্যগ্রন্থের কিছু লেখা আছে আনন্দ কিংবা বেদনার অশ্র“জলে আঁকা। নিবেদন বা নৈবেদ্য সিরিজের এই কবিতাগুলো মহিউদ্দিন তাহের তার পিতা-মাতা-শিক্ষাগুরু প্রমুখকে উৎসর্গ করে লিখেছেন। এরমধ্যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে লেখা কবিতাটি উল্লেখযোগ্য বিবেচনা করি
“জ্বালো আলো বৈভব স্বপ্ন সমান
আলোর শিশুরা ওই
গেয়ে ওঠো থৈ থৈ উদাত্ত প্রাণ:
চাই আলোর জন্যে মানুষ
চাই ভালোর জন্যে মানুষ
চাই পূর্ণপ্রাজ্ঞ মানুষ
কথা নয় কাজের মানুষ
দেশপ্রেমে পূর্ণ মানুষ।” (অনির্বাণ)
দেশপ্রেম, প্রেম, বিরহ, অণু কাব্য ছাড়াও চারটে সনেটও লিখেছেন মহিউদ্দিন তাহের। নানা ছন্দ, মাত্রা ও ভাবনায় পারদর্শীতা দেখিয়েছেন তিনি। পাঠক হিসাবে, দাবি তবু রয়েই গেলো, তার কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন করে প্রেম, দ্রোহ, সনেট ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা আলাদা বই চাই।